মুহাম্মাদ কাসেম নানুতুবী (রহঃ)।।প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম দেওবন্দ।।জীবনী।।taqwa-dawah
হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতুবী (রহঃ)
[প্রতিষ্ঠাতা, দারুল উলুম দেওবন্দ।
(১২৪৮ ইং ১২৯৭ ইং)
জন্ম ও বংশ পরিচয়: মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতুবী (রহঃ) ভারতের সাহারান পুর জেলার নানুতা নামক গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্ম তারিখ ১২৪৮ হিজরীর শাবান কিংবা রমজান মাস। পিতার নাম আসাদ আলী। তাঁর বংশপরম্পরা মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর (রাঃ) পর্যন্ত গিয়ে মিলিত হয়। পিতা আসাদ আলী তেমন শিক্ষিত ছিলেন না। তবে তিনি ভাল ফারসী জানতেন। তিনি পাকা নামাজী ও মুত্তাকী ব্যক্তি ছিলেন। চাল-চলনে একেবারেই সাদাসিধা, সহজ-সরল ছিলেন। মাওলানা নানুতুবী ছিলেন পিতার একমাত্র পুত্র।
শৈশব ও শিক্ষা-দিক্ষা: সাধারণতঃ বেশী আদরের সন্তানেরা শেষ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানীতে মাওলানা ছিলেন সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। শৈশব থেকেই তিনি তীক্ষ্ণ মেধাবী, চরিত্রবান, সাহসী, উন্নত মনোবল সম্পন্ন ও বুদ্ধিমান ছিলেন। পাকা পাকা বুদ্ধির কথা বলে তিনি সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতেন। যেহেতু এক সময় তিনি উম্মতের কর্ণধার হবেন, তাই শৈশব হতেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর উপর বিশেষ অনুগ্রহের বারিধারা বর্ষণ করেন। মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব (রহঃ) বলেন, "মৌলভী কাসেম ছোটবেলায় একবার স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, তিনি যেন আল্লাহ তায়ালার কোলে বসে আছেন। তাঁর দাদা এর ব্যাখ্যা এই দিয়েছিলেন যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাকে অশেষ এ দান করবেন। ফলে তুমি বড় ও বিখ্যাত আলেম হবে। দাদার এ ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে।"
মাওলানা নানুতুবী (রহঃ) আল্লাহ প্রদত্ত অসীম মেধার অধিকারী ছিলেন। তাই লেখাপড়া ছাড়া খেলাধুলায়ও তিনি বড় পারদর্শী ছিলেন। বড় বড় খেলোয়াড়ও তাঁর কাছে হেরে যেত। নানুতার মক্তবেই তিনি কোরআন পাঠ শিক্ষা করেন। পরে দেওবন্দ গিয়ে মাওলানা মাহতাব আলী সাহেবের কাছে দীনী শিক্ষা শুরু করেন। এখানে আরবী ও ফারসীর বিভিন্ন কিতাব পড়ে তিনি সাহারান পুর নানার কাছে চলে যান। নানার মৃত্যুর পর সে বছরই নানুতা চলে আসেন। তারপর ১২৫৯ হিজরীর যিলহজ্ব মাসে মাওলানা মামলুক আলী সাহেবের সঙ্গে দিল্লী চলে যান এবং তাঁর কাছেই কাফিয়া পড়তে শুরু করেন। মাওলানা ইয়াকুব (রহঃ) বলেন, "মৌলভী কাসেম সাহেব সব সময়ই ভালো ছাত্র ছিলেন। দিল্লীতে অধ্যয়ন কালে একদিন আমার বাড়ির নিকটে মৌলভী নওয়াজেশ আলীর মাদ্রাসা মসজিদে ছাত্রদের একটি সভা ছিল, তাতে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও তর্ক-বহস হয়। মৌলভী কাসেম সাহেবের পালা আসলে তিনি সকলের ওপর জয়লাভ করেন।
১২৬১ হিজরীর শেষের দিকে মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী (রহঃ); দিল্লীতে বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষা অর্জনের পর মাওলানার সহপাঠী হয়ে যান এবং অল্পদিনেই তাঁরা দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধুতে পরিণত হন। তাঁরা যেন একই এলমের আকাশে দুই নক্ষত্র। আরবীর প্রায় সব কটি কিতাব তাঁরা দু'জন মাওলানা মামলুক আলী সাহেবের নিকট অধ্যয়ন করেন। আর হাদীস হাদীস শিক্ষা করেন মাওলানা শাহ্ আব্দুল গণী সাহেবের নিকট। মাওলানা নানুতুবীর কবিতার প্রতি যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। ছোট বেলার খেলাধুলা ইত্যাদির কাহিনী তিনি অনর্গল ছন্দ আকারে বলতে পারতেন।
শিক্ষকতা জীবন: ছাত্র জীবন থেকেই তিনি শিক্ষকতার কাজ শুরু করেছিলেন। মাওলানা মামলুক আলী সাহেব মাওলানা ইয়াকুব আলী সাহেব (রহঃ)-কে ছরফ এবং নাহব এর কিতাবসমূহ পড়ানোর দায়িত্ব মাওলানা নানুতুবী (রহঃ)-এর ওপরই ন্যস্ত করেন। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তিনি তাকে পাঠদান করতেন। অবশেষে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষক নিযুক্ত হন। এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অধ্যপনার দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর স্বনামধন্য ছাত্রদের মধ্যে শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী (রহঃ) অন্যতম। মাওলানা নানুতুবী (রহঃ)-এর কৃতিত্বের স্বাক্ষর হিসেবে এ একজনের নাম উল্লেখ করাই যথেষ্ট।
আধ্যাত্মিক সাধনা: মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহঃ) হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (রহঃ)-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই হাজী সাহেবের সঙ্গে তাঁর আন্তরিকতা ছিল। মাওলানা নানুতুবী (রহঃ) মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী (রহঃ)-এর পরে মুরীদ হন এবং অসাধারণ চেষ্টা-সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির উন্নত স্তর অতিক্রম করে খেলাফত 'লাভকরেন। তিনি অত্যন্ত নম্র ও বিনয়ী ছিলেন। জীবনের শুরু থেকেই তাঁর একটা গুণ ছিল যে, তিনি বেশীর ভাগ সময়ই নীরব থাকতেন; কথা বলতেন একেবারেই কম। তাঁর সামনে কথা বলতে গেলে খুব চিন্তা করে বলতে হত। তাঁকে নাম ধরে ডাকলেই তিনি খুশী হতেন। চলাফেরা ছিল নিতান্তই সাধারণ। তিনি নিজেকে সব সময় গোপন করে চলতেন। আলেমদের কোন বেশভূষা যেমন- পাগড়ী, জুব্বা ইত্যাদি তিনি ব্যবহার করতেন না। তিনি বলতেন, এলমই আমাকে অসুবিধা করে দিল; অন্যথায় নিজেকে মাটির সঙ্গে এমন ভাবে মিশিয়ে দিতাম যে, কেউ আমাকে চিনতেই পারত না। মাওলানা আশরাফ আলী (রহঃ)-এর ভাষায়:"তিনি মোটা কাপড় পরতেন। একদিনের ঘটনা, তিনি দেওবন্দ থেকে নানুতা যাচ্ছিলেন। বেশভূষায় তাঁকে একেবারেই সাধারণ লোক মনে হচ্ছিল। পথে এক তাঁতী তাঁকে (তাতী মনে করে) জিজ্ঞেস করল, ভাই সূতার দাম আজ কী রকম জানেন? জবাবে তিনি বললেন, না ভাই আজ বাজারে যাওয়া হয়নি।" তিনি অত্যন্ত উঁচু দরের সাধক ও আল্লাহর ওলী ছিলেন। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী (রহঃ) বলেন, প্রথম যুগে এক সময় এক সময় এমন লোকের জন্ম হত। আজকাল আর এমন লোক জন্মায় না।
মুজাহিদ বেশে মাওলানা নানুতুবী: মাওলানা নানুতুবী (রহঃ)-এর
জীবনটাই ছিল অসাধারণ জীবন। তাঁকে একজন খাঁটি মুজাহিদ বলা যায়। তিনি বাতিলের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তাই জীবনের এক পর্যায়ে তিনি বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তরবারী নিয়ে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যুদ্ধের ব্যাপারে পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও রণাঙ্গনে তাঁর হাতিয়ার চালনা এবং বন্দুক ব্যবহারের দক্ষতা প্রমান করে যে, তিনি যেন সেনাবাহিনীর যোগ্য কমান্ডার। এ প্রসঙ্গে মাওলানা ইয়াকুব সাহেব (রহঃ) লিখেছেন:
তখন (১৮৫৭ সালে) অস্ত্র ছাড়া পথ চলা কঠিন ছিল। ফলে বাধ্য হয়ে আমরা রাইফেল চালনা শিক্ষা করতাম। একদিনের ঘটনা, আমরা রাইফেল চালনা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলাম। মাওলানা নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, দেখি তোমরা কিভাবে রাইফেল চালাও। একজন একটা ফায়ার করে লক্ষ্যস্থলে নিশানা করার নিয়ম শিখিয়ে দেয়। তিনি রাইফেল হাতে নিয়ে ফায়ার করলে গুলি ঠিক লক্ষ্যস্থলে গিয়ে আঘাত হানে। তাঁকে দ্বিতীয় বারের জন্য আর এর চর্চা করতে হয়নি। যুদ্ধ বিদ্যার এদক্ষতার কারণেই বৃটিশ বিরোধী লড়াইয়ে তাঁকে থানাভবন ও শামেলীর রণাঙ্গনের সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়েছিল।
১৮৫৭ সালের বিপ্লবের সময় যখন বৃটিশ সরকারের পক্ষথেকে গ্রেফতার অভিযান শুরু হয়, তখন তিনি মাত্র তিন দিন লুকিয়ে থেকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসেন। কারণ, তিন দিনের বেশী আত্মগোপন করা সুন্নত পরিপন্থী। একবার তিনি অনুসন্ধানকারী সিপাহীদের সামনে পড়ে যান, তারা হযরত নানুতুবী (রহঃ) কে চিনত না। তারা তাঁকেই জিজ্ঞেস করলঃ মাওলানা কাসেম সাহেব কোথায় বলতে পারেন? মাওলানা একটু সরে গিয়ে বললেন, এইতো একটু আগেইতো তিনি এখানে ছিলেন। রাজ-সিপাহীদের বোকা বানিয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সেবারের মত আত্মরক্ষা করেন।
পাদ্রীদের সঙ্গে বিতর্কে মাওলানা নানুতুবী (রহঃ): ইংরেজরা দীর্ঘ দু'শ বছর পর্যন্ত ভারত উপমহাদেশ শাসন করেছে। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি
দিয়ে তারা এদেশে ব্যবসার নামে এসেছিল। সাথে করে এনেছিল নাস্তিকতা, ধর্মহীনতা আর বিচ্ছিন্নতার তুফান। তাদের পলিসি এই ছিল যে, "এদেশের লোকদের মধ্যে পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাৎ বাধিয়ে রাখ, আর নিজেরা শাসন কর।" ভারত উপমহাদেশের লোকদেরকে বিশেষ করে মুসলমানদেরকে নাস্তিক বানাও আর নিজেদের আখের গোছাও। তারা একথা জানত যে, যতদিন পর্যন্ত ভারতের মুসলমানরা মুসলমান হয়ে টিকে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত দুনিয়ার কোন শক্তিই তাঁদের উপর শাসন করতে পারবে না। ফলে তারা দুটি পন্থা আবিস্কার করে নেয়।
প্রথমতঃ ইংরেজী শিক্ষার প্রসার। দ্বিতীয়তঃ খৃষ্টধর্ম প্রচারের জন্য পাদ্রীদের মোটা অঙ্কের বেতন দিয়ে ভারত বর্ষে প্রেরণ। ইংরেজী শিক্ষা এদেশের সভ্যতা সংস্কৃতিতে কিরূপ বিষাক্ত প্রভাব বিস্তার করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নাস্তিকতা, চরিত্রহীনতা ও বেহায়াপনা এ শিক্ষার অনিবার্য পরিণতি। আর এসত্য দিবালোকের মত যে জাতি নিজেদের ধর্মীয় শিক্ষা বর্জন করে বিজাতীয় শিক্ষা-সভ্যতা অবলম্বন করে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য। পাদ্রীরা ভারত উপমহাদেশে এসে খৃষ্টবাদের প্রচার শুরু করে দেয়। এ ধর্মান্তরের সয়লাবে অমুসলিমরাই গা ভাসিয়ে দেয় এবং স্বধর্ম ত্যাগ করে। প্রায়ই খৃষ্টান পাদ্রীদের সঙ্গে বিতর্ক হত। ভারতের শাহজাহান পুর জেলার চাঁদপুরে একটি বিতর্ক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপঃ
ঘটনাটি ১২৯৩ হিজরীর। শাহজাহান পুর জেলার একটি গ্রাম চাঁদপুর। মুন্সী পেয়ারে লাল পান্থী ছিলেন গ্রামের তৎকালীন মোড়ল। এক খ্রিষ্টান শিক্ষক সেখানে বাস করত এবং নিজের ধর্ম প্রচার করে বেড়াত। এক পর্যায়ে মুন্সী পেয়ারে লাল বিতর্কের জন্য সকল ধর্মের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একত্রিত করলেন। খৃষ্টানদের পক্ষ থেকেও বড় বড় বেশ কিছু পাদ্রী উপস্থিত ছিল। মুসলমানদের পক্ষ থেকে ছিলেনঃ (১) মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহঃ), (২) মাওলানা ফখরুল হাকীম গাঙ্গুহী, (৩) শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান, (৪) মাওলানা হাকীম রহীমুল্লাহ বিজনুরী, (৫) মাওলানা আবুল মনসুর দেহলবী, (৬) মাওঃ আহমাদ আলী ও (৭) মাওঃ মীর হায়দার আলী দেহলবী (রহঃ)।
মূলতঃ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয় মুসলমান ও খৃষ্টানদের মধ্যে। আল্লাহর মেহেরবানীতে মুসলমানরা জয়লাভ করেন। এ বিজয়ে মুসলমানদের মধ্যে মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহঃ)-এর কৃতিত্বই ছিল সবচেয়ে বেশী। অবশেষে
খৃষ্টান পাদ্রীরাও তাঁর প্রশংসা করতে বাধ্য হয়। পরে একদিন সায়্যেদ জহুরুদ্দীন সাহেব জনৈক পাদ্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা তুমি সেদিন কিছু বললে না কেন? জবাবে সে বলেছিল, মৌলভী সাহেব এমন কোন কথাটা বাদ দিয়েছেন যে আমি তা বলব? আমাদের পাদ্রী ন্যালস-ই তো কোন জবাব খুজে পান নি। পাদ্রী বলেন, "কী আর বলব, এ ধরনের বহু অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের সুযোগ আমার হয়েছিল। অনেক মুসলমান আলেমের সঙ্গেও আমি আলাপ করেছি। কিন্তু না এরূপ আলেম কখনো দেখেছি, না এরূপ বক্তৃতা কোনদিন শুনেছি।" পাদ্রী আরও বলেন, "বক্তব্য শুনেই যদি ঈমান আনা যেত তা হলে ওই লোকটার বক্তব্য শুনেই আমি ঈমান আনতাম।" অনেক হিন্দু এমনও বলত যে, দেবতা যদি একজন থেকে থাকে, তাহলে ঐ মৌলভী কাসেম সাহেবই আছেন।
পুস্তক রচনায় মাওলানা নানুতুবী (রহঃ): মাওলানা নানুতুবী (রহঃ)
রচিত বেশ ক'টি গ্রন্থ রয়েছে। মানের দিক থেকে এ যুগে যার তুলনা হয় না। সে কিতাব গুলো সম্পর্কে হাকীমুল উম্মত থানবী (রহঃ) বলেন: নানুতুবী (রহঃ) রচিত কিতাব গুলো যদি আরবীতে অনুবাদ করা হয় এবং লেখকের নাম উল্লেখ করা না হয়, তা হলে লোকে বলবে এগুলো ইমাম রাযী বা ইমাম গাজ্জালীর কিতাব। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে • তাকরীরে দেলপযীর তাহযিরুন্ নাস আবে হায়াত আকায়েদ হুজ্জাতুল ইসলাম মোবাহাসায়ে শাহজাহান পুর ইত্যাদি। উক্ত কিতাব গুলো তাঁর এন্তেসারুল ইসলাম তাস ফিয়াতুল কিবলা নুমা তুহফাতুল হামিয়া জামালে কাসেমী ও তাওসীকুল কালাম মাতৃভাষা উর্দুতে রচিত হলেও তা বোঝা সাধারণ লোকের তো দূরের কথা আলেমদের জন্যও দুষ্কর। কারণ, ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল হলেও বিষয়বস্তু অত্যন্ত জটিল।
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠায় মাওলানা নানুতুবী (রহঃ): ছাত্র জীবনে মাওঃ নানুতুবী
(রহঃ) স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, "তিনি কাবা ঘরের ছাদে বসে আছেন এবং তাঁর পায়ের নীচে থেকে হাজার হাজার নদী প্রবাহিত হচ্ছে।" মাওলানা মামলুক আলী (রহঃ) এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করেছেন যে, ভবিষ্যতে তোমার দ্বারা ইসলামী ইলমের প্রসার হবে। বস্তুত হয়েছেও তাই। পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম ভূ-খণ্ডের লোক মাওলানা নানুতুবী (রহঃ)-এর ইলমী ফয়েজ লাভে ধন্য হয়েছে। দারুল উলুম দেওবন্দ তাঁরই সাধনার ফসল। সাহারানপুরের মাজাহেরে উলুম মাদ্রাসার ভিত্তি প্রস্তরও তাঁরই হাতে হয়েছে। তাছাড়া ভারতের মাদ্রাসা শাহীমুরাদাবাদ, মাদ্রাসা ইসলামিয়া আমরোহা সব তাঁরই বরকতের ফল। এসব মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা বিভিন্ন জন হলেও মূল চিন্তাধারা ও পরিকল্পনা নানুতুবী (রহঃ)-এর। তিনিই এ পদ্ধতিতে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারের গোড়াপত্তন করেন।
বায়'আতের ধারা ও খলীফাবৃন্দ: মাওলানা নানুতুবী (রহঃ) বায়'আত
করতেন না। কেউ বায়'আতের আবেদন জানালে তা প্রত্যাখ্যান করতেন। মাওলানা নানুতুবী (রহঃ) এতদসংক্রান্ত একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তা হলোঃ এক ব্যাক্তি মাওলানার কাছে এসে হাদিয়া স্বরূপ কিছু মিষ্টান্ন পেশ করে। পরদিন এসে লোকটি বললঃ হযরত! আমাকে বায়'আত করুন। মাওলানা নানুতুবী বললেন, আমিতো বায়'আত করিনা। অন্য কারো নিকট গিয়ে বায়'আত হও। লোকটি বলল, তাহলে আমার মিষ্টি ফেরত দিন। তিনি খাদেমকে ডেকে বললেন, যে পরিমাণ মিষ্টি লোকটি এনেছিল সে পরিমাণ মিষ্টি এনে তাকে দিয়ে দাও। মিষ্টি আনা হলে লোকটি বললঃ না, আমি এ মিষ্টি নেব না। আমি যে মিষ্টি এনেছিলাম, ঠিক তাই দিতে হবে। অন্যথায় আমাকে বায়'আত করতে হবে। অগত্যা বাধ্য হয়ে তিনিা তাকে বায়'আত করে নেন।
অনুরূপভাবে মাওলানা মুহাম্মাদ সিদ্দীক মুরাদাবাদী মাওলানা নানুতুবী (রহঃ)-এর খেদমতে এসে বায়'আতের আবেদন জানালে তিনি বললেন, আমি এর যোগ্য নই। আপনি অমুক কিংবা অমুকের কাছে গিয়ে বায়'আত গ্রহণ করুন। কিন্তু মাওলানা মুরাদাবাদীও ছাড়বার পাত্র নন। বারংবার পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। অবশেষে নানুতুবী (রহঃ) বললেন, আপনি মাওলানা গঙ্গুহী (রহঃ)-এর নিকট গিয়ে বায়'আত হউন। মাওলানা মুরাদাবাদী বললেন, না আমি আপনার কাছে বায়'আত হব। নানুতুবী (রহঃ) বললেন, আরে মিয়া, আমি নিজেও তো মাওলানা গঙ্গুহীর ভক্ত। মুরাদাবাদী বললেন, তা থাক, আমি তো ভক্তি করি আপনাকে। আট দিন চলে গেল, হযরত তাকে বায়'আত করলেন না। হযরতও টালবাহানা করতে থাকেন, আর উনিও অটল হয়ে পিছনে পিছনে হাঁটতে থাকেন। অবশেষে বিভিন্ন জনের জোর সুপারিশে বাধ্য হয়ে মাওলানা মুরাদাবাদীকে বায়'আত করে নেন। তাঁর খলীফাদের মধ্যে মাত্র দু'জনের নাম জানা যায়। (১) মাওলানা আহমদ হাসান মুহাদ্দেস আমরোহী, (২) মাওলানা মুহাম্মাদ সিদ্দীক মুরাদাবাদী।
অনুসরণীয় আদর্শ জীবন: মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহঃ)-এর গোটা জীবনই আমাদের জন্য অনুসরণ যোগ্য। নিম্নে তাঁর আদর্শ জীবনের বিশেষ কিছু নমুনা পেশ করা হলো।
(১) মাওলানা কাসেম কাসেম নানুতুবী (রহঃ)-এর দু'মেয়ে ছিল। উভয় মেয়েকে তিনি সুন্নাত মোতাবেক বিয়ে দেন। কোন প্রকার প্রচার ছাড়াই কোন এক জুমার নামাজের পর বিবাহ কার্য সম্পন্ন করেন। শুধুমাত্র মাওলানা গঙ্গুহীকে পূর্বে অবহিত করেছিলেন। তাছাড়া বিবাহের আগে অন্য কেউ জানতে পারেনি।
(২) মাওঃ মুহাম্মাদ ইয়াকুব (রহঃ)-এর শাক-সব্জীর খুব সখ ছিল। ঘরের সামনে তিনি কিছু ধনিয়া ও পুঁদিনা গাছ রোপন করেছিলেন। তাতে কিছু জৈব সার ও গোবরের প্রয়োজন ছিল। ঘটনাক্রমে সেখান দিয়ে এক জমিদারকে যেতে দেখে তাকে গোবরের কথা বললেন। জমিদার তার এক প্রজাকে ডেকে তার মাথায় এক টুকরি গোবর পাঠিয়ে দেয়। ঘটনাক্রমে মাওলানা নানুতুবী তা জানতে পেরে অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, বলা তো যায় না জমিদার লোকটির ওপর জুলুম করেছে কিনা। হতে পারে অন্যায়ভাবে ও জোরপূর্বক সে লোকটির মাথায় গোবরের টুকরি তুলে দিয়েছে। এ গোবর ব্যবহার করা ঠিক হবে না। এসব ফেরত দেয়াই উত্তম হবে। মাওঃ ইয়াকুব সবগুলো গোবর নিজ হাতে একত্র করে জমিদারের বাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দিলেন।
(৩) একবার তিনি ভারতের রামপুর গিয়েছিলেন। সেখানকার নবাব সাহেব সংবাদ পেয়ে সাক্ষাত করার জন্য হযরতকে ডেকে পাঠান। জবাবে হযরত প্রথমে বললেন, আমি গাঁও-গ্রামের মানুষ। শাহী দরবারের আদব-কায়দা আমার জানা নেই। নবাব সাহেব বলে পাঠালেন, শাহী দরবারের সকল আদব-কায়দা আপনার জন্য মাফ। একথা শুনে মাওলানা নানুতুবী বললেন, এতো এক অদ্ভুত কথা সাক্ষাত করার সখ আপনার, আর যেতে হবে আমাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি গেলেনই না।
(৪) এক ব্যক্তি একবার হযরতকে দাওয়াত করেন। তখন ছিল বর্ষাকাল। তিনি ওয়াদা দিলেন, মাগরিবের পরে আমি তোমার বাসায় যাব। লোকটির বাসা ছিল শহরের বাইরে ঘটনাক্রমে মাগরিবের সময় মুষলধারে বৃষ্টি নামে। দারুল উলূম থেকে উক্ত লোকটির বাসা পর্যন্ত পানি আর পানি। কিন্তু মাওলানা নানুতুবী (রহঃ) কোমর পরিমান পানি অতিক্রম করে লোকটির বাসায় গিয়ে হাজির হন। লোকটি তো অবাক! ভয়ে হযরতের সামনে এসে, সালাম দিয়ে চাঁপা কণ্ঠে বলল, হযরত! বৃষ্টির কারণে আপনি আসবেন না মনে করে কোন কিছুরই ব্যাবস্থা করি নি। মাওলানা সাহেব বললেন, অসুবিধা নেই, ঘরে যা আছে তাই নিয়ে এস। উপস্থিত যা ছিল তাই খেয়ে, ওয়াদা পালন করে তিনি ফিরে আসেন।
হজ্জ্ব পালন: মাওলানা নানুতুবী (রহঃ) দুই বার হজ্জকার্য সম্পাদন করেন।
প্রথমবার ১২৭৭ হিজরীতে মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবীর (রহঃ) সাথে। দ্বিতীয়বার ১২৯৪ সালে হযরত মাওলানা গাঙ্গুহীর (রহঃ) সাথে বহু উলামায়ে কেরাম ও বিশাল কাফেলা সহ। রবিউল আউয়াল (১২৯৫হিঃ) যখন দেশে ফিরছিলেন, জেদ্দা পৌঁছেই তিনি ভিষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। আর ঘটনাক্রমে জাহাজে এমন মহামারী দেখা দেয় যে, প্রতিদিন দু'একজন করে লোক মারা যাচ্ছিল। দেশে আসার পর যদিও জ্বর হতে সেরে উঠলেন, কিছুদিন পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে এ রোগেই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন।
ওফাত ও নামাযে জানাযা : ১২৯৭ হিজরীর ৪ঠা জুমাদালউলা
বৃহস্পতিবারে ৪৯ বৎসর বয়সে মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহঃ) ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাযার নামাযে এমন কিছু লোক অংশ গ্রহণ করেছিলেন, যাদের পূর্বে কখনো দেখা যায় নি এবং জানাযার পরে হঠাৎ করে উধাও হয়ে যায়। তাঁকে দারুল উলূম দেওবন্দের নিকটেই সমাহিত করা হয় এবং তাঁর নামানুসারে কবরস্থানটির নাম করন করা হয়, 'মাকবারায়ে কাসেমী'। যেখানে বহু আকাবেরে দেওবন্দ শায়িত আছেন।