সীরীন (রহঃ)এর জীবনী।।আল্লাহ ওলাদের জীবনী।

 আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রহঃ)-এর
সংক্ষিপ্ত জীবনী


প্রখ্যাত তাবেয়ী আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে সীরীন (রহঃ)-এর জন্ম সম্পর্কে যতদূর জানা যায়, তিনি ইসলাম জগতের তৃতীয় খলীফা হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রাঃ)-এর শাহাদতের (যিলহজ্জ, ৩৫ হিজরী) দু'বছর পূর্বে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম 'মুহাম্মদ', উপনাম 'আবু বকর', পিতার নাম 'সীরীন'। ইসলামের ইতিহাসে তিনি আরব্য রীতি অনুসারে 'সীরীন-পুত্র' তথা 'ইবনে সীরীন' নামেই সমধিক খ্যাত।


আল্লামা মুহাম্মদ-এর পিতা সীরীন 'আইনুত্ তামার' যুদ্ধে মুসলিম সিপাহ- সালার হযরত খালিদ ইবনে ওলীদ (রাঃ)-এর হাতে বন্দী হন। হযরত রসূলে করীম (দঃ)-এর বিশিষ্ট খাদেম ও ঘনিষ্ঠ সহচর হযরত আনাস (রাঃ) তাঁকে ক্রয় করে মুক্তি প্রদান করেন। ইসলামের মানবিক রীতিতে যুদ্ধলব্ধ দাসের জীবন সমাপ্ত হলে সীরীনের ঔরসে জন্মগ্রহণকারী সন্তানদের দ্বারা তাঁর সুনাম অভাবনীয়রূপে বৃদ্ধি পায় এবং ইতিহাসে তাঁর পরিবারটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে সীরীন-এর অপর ভাই-বোন যথা আনাস, মা'বাদ, ইয়াহ্ইয়া, হাফসা ও কারীমা এদের প্রত্যেকেই বিশিষ্ট তাবেয়ী ছিলেন।


সর্বাপেক্ষা বেশী প্রখ্যাত সন্তান আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে সীরীন বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ইবনে ওমর (রাঃ), হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ), হযরত আনাস (রাঃ), হযরত যায়েদ ইবনে সাবেত (রাঃ), হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রাঃ) এবং উম্মুল মু'মিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) প্রমুখের নিকট থেকে কোরআন-হাদীসের শিক্ষা ও ইসলামী তত্ত্বজ্ঞান লাভ করেন।


স্বপ্নের ব্যাখ্যা তথা তা'বীরুর রু'য়া শাস্ত্রে তাঁর কৃতিত্ব ও সুখ্যাতি ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সীরীনের অপরাপর গুণ ও প্রতিভাকে এমনভাবে ছাপিয়ে যায়, যাতে মনে হয় যে, তিনি কেবল স্বপ্নের মর্ম ও ব্যাখ্যা শাস্ত্রেরই লোক ছিলেন। অথচ এ বিখ্যাত তাবেয়ী একাধারে বড় আলেম, আবেদ, যাহেদ এবং বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মুহাদ্দিসও ছিলেন। অসংখ্য মানুষ কোরআন, হাদীস, ফিকাহ ও তা'বীর শাস্ত্রে তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করে সমকালীন বিশ্বে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর কৃতী ছাত্রদের ধ্যে ইমাম কাতাদা, ইমাম শা'বী, সাবেত, মালেক ইবনে দীনার, সুলায়মান তাইমী, খালিদ হায্যা, আইয়ূব এবং ইমাম আওযায়ীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


ইতিহাস ও রিজাল শাস্ত্রে (চরিতাভিধান) ইমাম ইবনে সীরীন সম্পর্কে যতদূর উল্লেখ পাওয়া যায়, তার আলোকে বোঝা যায় যে, তিনি ছিলেন যুগের সেরা একজন মনীষী আলেম ও উচ্চ পর্যায়ের বুযুর্গ ব্যক্তি। বর্ণিত আছে, ইমাম ইবনে সীরীন (রহঃ) জীবনভর একদিন অন্তর রোযা পালন করতেন। অর্থাৎ একদিন তিনি রোযা রাখতেন পরদিন রোযা ছাড়া কাটাতেন। তৃতীয় দিন পুনরায় রোযা রাখতেন এবং তার পরদিন রোযা ছাড়া কাটাতেন। রমযান ছাড়া এ ভাবেই তাঁর সারা বছর কেটে যেতো।


ওসমান বিত্তি বলেন, ন্যায় ও সুবিচার সম্পর্কে ইমাম ইবনে সীরীনের চেয়ে বেশী প্রজ্ঞাবান আর কোন ব্যক্তিই বসরায় ছিল না। আবু আওয়ানা বলেন, আমি বাজারেও তাঁকে লক্ষ্য করেছি। বাজারে চলাফেরা অবস্থায়ও যে তাঁকে দেখেছে, আল্লাহকে স্মরণ করেছে। হিশাম ইবনে হাসান বলেন, আমার পরিচিত জনসমষ্টির মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে সীরীনই ছিলেন সর্বাপেক্ষা স্পষ্টবাদী ও সত্যভাষী। মুআররেক আজালী বলেন, আমি ইবনে সীরীনের মতো খোদাভীরু, পরহেযগার, সূক্ষ্মদর্শী, প্রজ্ঞাবান এবং ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কিত গভীর জ্ঞানের অধিকারী আর কাউকে দেখিনি। তাকওয়া সম্পর্কে তিনিই ছিলেন সর্বাপেক্ষা বেশী পরিজ্ঞাত আর ফিক্‌হী মাসআলা সম্পর্কে অধিক প্রাজ্ঞ।


খাল্‌ল্ফ ইবনে হিশাম বলেন, আল্লাহ্ তা'আলা মুহাম্মদ ইবনে সীরীনকে এমন উত্তম চরিত্র এবং বিনয় দান করেছিলেন যে, তাঁকে দেখলেই আল্লাহর কথা স্মরণ হতো। আশআস বলেন, মুহাম্মদ ইবনে সীরীনকে ফিকাহ সংক্রান্ত কোন মাসআলা তথা হালাল-হারাম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তাঁর চেহারা এতই বিবর্ণ হয়ে পড়তো, মনে হতো যেন ইনি সেই ইবনে সীরীন নন, অন্য কেউ। মাহদী ইবনে হাসান বলেন, আমরা প্রায়ই মুহাম্মদ ইবনে সীরীনের কাছে যাতায়াত করতাম। তিনি আমাদের সাথে কথাবার্তা বলতেন, আমরাও অসংকোচে তাঁর সাথে কথা বলতাম। কিন্তু কখনো মৃত্যুর আলোচনা শুরু হলে তাঁর চেহারা এমন ফ্যাকাসে ও বিবর্ণ হয়ে যেতো, মনেই হতো না যে ইনি সেই ব্যক্তি যার সাথে আমরা এতক্ষণ কথা বলছিলাম। এ মহান জ্ঞানতাপস ৭৭ বছর বয়সে ১১০ হিজরীর ৯ই শাওয়াল ইহলোক ত্যাগ করেন।


আরো পড়ুনঃ


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url