হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহঃ)।। দেহলবী জীবনী।। taqwa-dawa

 হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহঃ)


(১৭০৩ ইং- ১৭৬২ ইং)


জন্ম ও বংশ পরিচয়: হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী (রহঃ)


১৭০৩ ইং বৃহস্পতিবার সূর্যোদয়ের সময় উত্তর ভারতে অবস্থিত (তাঁর নানাবাড়ি) মুজাফ্ফর নগর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মূল নাম আহমদ, উপাধী আবুল ফয়েজ, ঐতিহাসিক নাম আযীমুদ্দীন। তবে তিনি ওয়ালীউল্লাহ নামেই জগদ্বিখ্যাত। তাঁর পিতা শাইখ আব্দুর রহীম বংশগত দিক থেকে হযরত উসমান (রাঃ)-এর বংশধর, মতান্তরে হযরত উমর (রাঃ)- এর বংশধর। তাঁর মাতা ইমাম মুছা আল কাযিমের বংশধর।


শিক্ষাকাল: শৈশবেই তাঁর আচার-আচরণ ও সময়ানুবর্তিতার মধ্যে ভবিষ্যত মাহাত্ম্যের আভাস পাওয়া যায়। জযবে লতীফ নামক গ্রন্থে শাহ্ সাহেব নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, যখন আমার পাঁচ বছর বয়স, তখন মক্তবে ভর্তি হই এবং পিতার নিকট ফার্সী শিক্ষা করি। সাত বছর বয়সে আমার পিতা আমাকে নামায পড়ার আদেশ দেন এবং ঐ বছরই পবিত্র কুরআনের হিফজ সমাপ্ত করি। অতঃপর পনর বছর বয়সের মধ্যেই তাফসীর, হাদীস, ফিকাহ্, উসূলে ফিকাহ্, তর্কশাস্ত্র, কালাম, চিকিৎসা বিজ্ঞান, জ্যামিতি ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন করি। চৌদ্দ বছর বয়সে স্বীয় পিতার হাতে বায়আত গ্রহণ করি এবং এ বছরে আমি বিবাহ করি। বিবাহের মাত্র দু'বছর পর পিতার ইন্তেকাল হয়।


কর্মজীবন: পিতার ইন্তেকালের পর শাহ্ সাহেব মাদ্রাসায়ে রহীমিয়াতে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। এ সময় দীর্ঘ বার বছর যাবৎ শাহ্ সাহেব তাঁর পরিবার ও সমাজকে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং বহু উত্থান-পতন দেখার পর উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, মুসলিম জাতিকে চলমান সমাজের অন্ধতা ও গোমরাহী থেকে বাঁচাতে হলে তিনটি বিষয় একান্ত প্রয়োজন,

(১) যুক্তি দর্শন: শাহ সাহেব উল্লেখ করেন যে, তৎকালে মুসলমানেরা গ্রীক দর্শনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিল। আর এই দর্শনের মূল ভিত্তি হল তর্কশাস্ত্র। ফলে তখন মুসলিম সমাজে নানা রকম ফিৎনা-ফাসাদের অনুপ্রবেশ ঘটে। সুতরাং সমাজকে এ রোগ থেকে মুক্ত করতে হলে, যুক্তি-দর্শন শিক্ষা করা একান্ত প্রয়োজন।


(২) আধ্যাত্মিক দর্শন বা তত্ত্বদর্শন: সে যুগের মুসলমানেরা কুরআন-সুন্নাহকে উপেক্ষা করে শুধু আধ্যাত্মিক সাধনাকে সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করত। এমন কি সূফীদের অনুমোদন ছাড়া তারা কোন কিছুই সত্য বলে বিশ্বাস করত না। তাই যুগের প্রেক্ষাপটে আধ্যাত্মিক সাধনা তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অংশ বলে বিবেচিত হত।


(৩) ইলম বির-রিওয়ায়াহ: অর্থাৎ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন হয়েছিল, এর মধ্যে কুরআনই প্রধান।


শাহ্ সাহেব বলেন, উক্ত তিনটি বিষয় ছাড়াও তৎকালীন যুগের শিক্ষিত ব্যক্তিরা আত্মকেন্দ্রিকতার রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। কোন জটিল বিষয়ের সম্মুখীন হলে, কেউ কারো সাথে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না। ছোট বড় সবাই নিজ নিজ ধারনা অনুযায়ী শরীয়ত সংক্রান্ত বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। এ অবস্থার প্রেক্ষিতে তাঁকে উপযুক্ত তিনটি বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করতে হয়েছে। বার বছর যাবৎ আলোচনা, পর্যালোচনা ও গবেষণার পর সংস্কার দ্বারা সত্যোদ্ধারকে তাঁর বিপ্লবী আন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে গ্রহণ করেন এবং এ ব্যাপারে তিনি মৌলিকভাবে দুটি বিষয়ের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেন:


(১) মানুষের ব্যবহারিক জীবন সম্পর্কে কুরআনের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রকৃত পক্ষে কুরআনের অলৌকিকত্ব। পবিত্র কুরআনের এ ব্যবহারিক মূল্যায়নের প্রতিষ্ঠাকে তিনি তাঁর শিক্ষা সংস্কারের বুনিয়াদ রূপে গ্রহণ করেছিলেন।


(২) সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অভাবকে সমাজ-রাষ্ট্র ও জাতীয় জীবনের নৈতিক ব্যবহারিক বিপর্যয় ও বিশৃংখলার কারণ বলে তিনি নির্দেশ করেছিলেন।


শাহ্ সাহেব এই দুইটি বিষয়কে সামনে রেখে তাঁর আন্দোলনের পথে যাত্রা শুরু করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, যদি কুরআনের অলৌকিকত্ব একমাত্র তাঁর ভাষাগত অলংকারেই সীমাবদ্ধ হয়, সেক্ষেত্রে কেবল নির্দিষ্ট সংখ্যক লোকব্যতীত আর সবাই কুরআনের মাধুর্য থেকে বঞ্চিত থাকবে। তাই তিনি কুরআনের ব্যবহারিক দিক ও অর্থনৈতিক সমতাকেও তাঁর সংস্কারমূলক কর্মসূচীর অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। সাধারণভাবে নৈতিক জীবনবোধই হচ্ছে আধ্যাত্মিকতার ভিত্তি। আর নৈতিকতার বিকাশ তখনই ঘটবে, যখন অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া যাবে। কিন্তু মানব জীবনের সাথে জীবিকার এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক কেউ কোনদিন উপলব্ধি করেনি। ফল হয়েছে এই যে, আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা সারশূন্য হয়ে পড়েছে। বিদ্বান ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা দেশের রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকাকেই জীবনের সাফল্য বলে মনে করত। পক্ষান্তরে শাহ্ সাহেব এ বাস্তবতাকে হকের নিরিখে বিচার করেছেন। তাঁর লিখিত গ্রন্থ 'হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ'-তে এ বিষয়ে বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। মোটকথা সমাজ জীবনে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিধান একান্ত জরুরী। কারণ, জীবিকা সংস্থানের দুশ্চিন্তা থেকে অবকাশ লাভের পরেই মানুষ নীতি, আদর্শ ও অন্যান্য দিকের উন্নতির প্রতি মনোযোগ দিতে পারে। নচেৎ মানবজীবন পশুজীবনে পরিণত হওয়া স্বাভাবিক। শাহ্ সাহেব এ সত্য উপলব্ধি করে মুসলিম মিল্লাতকে এ ঘোর অমানিশা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এ বিষয়ে সুষ্ঠু ও তত্ত্বমূলক গবেষনার জন্য তৈরী হন। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন হাদীস শাস্ত্রে পূর্ণ পাণ্ডিত্য। দিল্লীতে আশানুরূপ হাদীস গ্রন্থ না থাকায় তাকে হিজাযে সফর করতে হয়।


হিজায সফর: শাহ্ সাহেব নিজে উল্লেখ করেন, দীর্ঘ বার বছর যাবৎ এ সকল বিষয়ে গবেষণা করার পর মক্কা-মদীনায় সফরের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ জন্মে। সুতরাং ১১৪৩ হিজরীতে মক্কা শরীফ চলে যাই এবং দু'বছর সেখানে অবস্থান করে শায়খ আবু তাহির ও অন্য আলেমগণের নিকট হাদীছ অধ্যয়ন করি। তিনি শাইখ আবু তাহির থেকে তাসাউফ-এর খিরকা লাভ করে ১১৪৫ হিঃ সনে দিল্লীতে ফিরে এসে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন।


সংস্কার আন্দোলনের জন্য ফিকাহ ও হাদীছ শাস্ত্রে স্বাধীনভাবে ইজতেহাদের যোগ্যতা অর্জন করা আবশ্যক। মক্কা-মদীনায় অবস্থান করে শাহ সাহেব এই বিষয়ে পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেন। তাঁর দাবী ছিল, বাদশাহ আকবরের, উদার নীতিতে যে নিয়ম ও রীতির প্রচলন হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে নতুনভাবে শাসন ব্যবস্থা তৈরী করা একান্ত প্রয়োজন। এ দাবীকে সামনে রেখে তিনি তাঁর আন্দোলনের কর্মসূচী পেশ করেন। তাঁর কর্মসূচীকে মোটামুটি আটটি ধারায় বিভক্ত করা যায়।(১) মুসলিম জাতির আকীদার সংশোধন ও কুরআনের প্রতি আহবান,

প্রকৃতপক্ষে কোন দেশে সংস্কার আন্দোলন দ্বারা মানুষের আত্মশুদ্ধি করা অত্যন্ত কঠিন ব্যপার। এর জন্য প্রয়োজন আম্বিয়ায়ে কিরামের সংস্কার ধারা বজায় রেখে দ্বীনের পূর্ণ জাগরণ সৃষ্টি করা। সম্রাট আকবরের প্রবর্তিত তথাকথিত উদার নীতির ফলে মুসলমানদের ঈমান-আকীদার ক্ষেত্রে যে বিশৃংখলা বিরাজ করছিল, তা সকলেরই জানা। সহজ-সরল মুসলিম জাতির বিভিন্ন ভাবধারা ও দর্শনপন্থীদের সাথে মেলামেশার ফলে, বিশেষ করে সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দু সংস্কৃতির একক প্রাধান্যের কারণে ভারতবর্ষে শুধু নামধারী মুসলমানদের অস্তিত্ব ছিল। ইসলামী ধ্যান-ধারনা, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসের সাথে তাদের ব্যবধান ছিল আকাশ-পাতাল।


শাহ্ সাহেব এ সত্যকে উপলব্ধি করে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এ বিপর্যয় থেকে মুসলিম জাতিকে হেফাজত করতে হলে ব্যাপকভাবে কুরআনের দাওয়াত প্রচার করতে হবে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআন সার্বজনীন ও আন্তজার্তিক। যে কোন যুগে যে কোন স্থানে এর বৈপ্লবিক নীতিকে অনুসরণ করলে, ইসলামের প্রাথমিক যুগের (খুলাফায়ে রাশেদীনের) ন্যায় নব জাগরণের সূচনা সম্ভব। এ কাজের আঞ্জাম দিতে গিয়ে তিনি সর্বপ্রথম ফার্সী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ করেন। যার নাম 'ফুতুহুর রহমান'। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁকে অনেক বিপদের সম্মুখিন হতে হয়েছে। এক শ্রেণীর আলেম তো বলেই উঠলেন, কুরআনের ভাষান্তর দ্বারা এর অলৌকিকত্ব ও মাধুর্যতা ক্ষুণ্ণ হয়। সুতরাং এ কাজ কুফরীর সমতুল্য। এক পর্যায়ে শাহ সাহেবের বিরুদ্ধে কুফুরী ফতোয়া দেয়া হয়। কিন্তু এ কথা চির সত্য যে, "কুকুরের ঘেউ ঘেউ চন্দ্রের আলোকে নেভাতে পারে না"। তাই তাঁর অবদান পৃথিবীতে স্বীকৃত রূপে বিরাজমান রইল।


(২) ক. জনসাধারণের মাঝে হাদীস ও সুন্নাহ ব্যাপক ভাবে প্রচার ও প্রসার ঘটানো: এ বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে জানতে হবে, দ্বীনের মধ্যে হাদীসের গুরুত্ব কতটুকু? হাদীসের প্রচার ও তার সংরক্ষণ প্রয়োজন কেন? হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা বা অবহেলা প্রদর্শনে কী ক্ষতি?


প্রকৃতপক্ষে হাদীস হলো উম্মতের ঈমান-আকীদার জন্য মানদণ্ড তথা মাপকাঠি স্বরূপ। শাহ্ সাহেবের প্রথম কর্মসূচী ছিল-কুরআনের প্রতি আহবান। এ কাজের জন্য হাদীসের প্রয়োজন কতটুকু তা আর আলোচনার অপেক্ষারাখে না। তার কারণ, পবিত্র কুরআনের ব্যাখ্যাই হলো সুন্নতে নববী। এরশাদ হচ্ছে, "রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাঝে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ।"


ভারতে যে শিরক-বিদআতের সয়লাব দেখা দিয়েছিল, তার একটা কারণ এও ছিল যে, হাদীস ও সুন্নতে নববীর প্রতি অবহেলা ও অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হত। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, "যখন কোন সম্প্রদায় একটি বিদআতে লিপ্ত হয়, তখন তাদের থেকে একটি সুন্নাত উঠিয়ে নেয়া হয়।" (মিশকাত) শাহ্ সাহেব সমাজ থেকে শিরক-বিদআতের প্রচলন রহিত করার জন্য সুন্নাতে নববী এবং হাদীসশাস্ত্রের ব্যাপক প্রচার প্রসার শুরু করেন। মূলতঃ তিনিই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম হাদীসের দরস চালু করেন। হাদীসের ক্ষেত্রে তাঁর অনেক অবদান রয়েছে। তন্মধ্যে তাঁর লিখিত মুছাফ্ফা, মুছাওয়া, শরহে তরজমায়ে সহীহ বুখারী, আল-ফসলুল মুবীন মিন হাদীসিন নাবিয়ি‍্যল আমিন ইত্যাদি গ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


খ. ফিকাহ ও হাদীসের মাঝে সমন্বয়: যুগ যুগ ধরে মুসলমানেরা হাদীস ও ফিকাহের চর্চা করে আসছে, কিন্তু তা ছিল বিচ্ছিন্ন ভাবে। শাহ্ সাহেব সর্বপ্রথম হাদীস ও ফিক্সের মাঝে সমন্বয় সাধন করেন।


(৩) যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যার আলোকে কুরআনিক দৃষ্টিভঙ্গির উপস্থাপন এবং সুন্নাতে নববীর রহস্য উৎঘাটন: অনেকে ধারণা করে থাকেন যে, শরীয়তের হুকুম-আহকাম কোন উদ্দেশ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কাজের সাথে তার ফলাফলের কোন সম্পর্ক নেই। এ ধারণা ভুল। ইজমা, কিয়াস ও খাইরুল কুরুন উক্ত মতবাদকে খণ্ডন করেছে। যেমন, নামায। এ হুকুম আল্লাহকে স্মরণ করা এবং তার মুনাজাতের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গরীব ও অসহায়দের অভাব অনটন দূর করা এবং অন্তর থেকে কৃপণতার ছাপ মুছে ফেলার জন্য যাকাতের বিধান দান করা হয়েছে। অন্তরকে কুপ্রবৃত্তির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার জন্য সিয়াম বা রোজা ফরজ করা হয়েছে। আল্লাহর বাণীর ব্যাপক প্রচার প্রসার এবং ফিৎনা-ফাসাদ দূর করার লক্ষ্যে জিহাদের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, প্রভৃতি। অনুরূপ ভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ- নিষেধের মাঝেও কোন কোন রহস্য লুক্কায়িত রয়েছে। যেমন যোহরের পূর্বে চার রাকাত নামায সম্বন্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, "ঐ সময় আকাশের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়, আমার ইচ্ছে হয় এ সময় যেনআমার নেক আমল উর্ধ্বারোহণ হয়।" এভাবে প্রত্যেক হুকুমের মাঝে কোন না কোন রহস্য লুকায়িত রয়েছে। এক শ্রেণীর মানুষ মনে করত, ইসলামী হুকুম- আহকাম যুক্তির আলোকে বিশ্লেষণ করা এবং এগুলোর রহস্য উদঘাটন করা ইসলামের জন্য ক্ষতিকারক। শাহ্ সাহেব বলেন, এ ধারণা ভুল। কারণ যুক্তির আলোকে ইসলামী হুকুম আহকামের বিচার বিশ্লেষণ করলে ক্ষতি নয় বরং উপকার হবে। যেমন আমলের প্রতি আগ্রহ বাড়বে, এছাড়া ফিক্বী ইজতিহাদের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে। এদিকে লক্ষ্য করে শাহ্ সাহেব এ কাজকে তাঁর বিপ্লবী কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত করেন।


(৪) ইসলামী খিলাফতের ব্যাখ্যা ও তার সত্যতা প্রমাণ এবং বিরুদ্ধবাদীদের সমুচিত জবাব: আল্লাহ পাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার দাসত্ব করার জন্য। সাথে সাথে পৃথিবীর পরিচালনা সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ারজন্য যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা হল 'খিলাফত'। এই খিলাফত মানব জীবনের একটি মৌলিক বিষয়। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বহু কল্যাণকর দিক। শাহ্ সাহেব এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীতা জনসাধারনের মাঝে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যার নজীর নেই। তিনি তাঁর 'ইযালাতুল খিফা' নামক গ্রন্থে খিলাফতের ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন,


"খিলাফত অর্থ- সাধারণের ক্ষমতা লাভ করায় ইলমে দ্বীনকে জিন্দা করার মাধ্যমে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করার জন্য, ইসলামের নীতি-বিধান ও জিহাদ এবং তার সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি যেমন সৈন্য বিন্যাস, যোদ্ধা তৈরী ইত্যাদি সংস্থাপনের জন্য এবং দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা, জুলুম-শোষন বিনাশ করা, সুপথের আদেশ ও কুপথের নিষেধ প্রভৃতিকে কায়েম করা হযরত রসুলে খোদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্থলাভিষিক্ত রূপে।"


এসময় আরো একটি বিষয় মুসলমানদের মাঝে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল, তা হল খিলাফতে রাশেদা সম্পর্কে বিভিন্ন ধরণের সন্দেহ প্রকাশ। শাহ্ সাহেব বিরুদ্ধবাদীদের এসকল ভ্রান্ত ধারণাকে এমন ভাবে খণ্ডন করেন, যা যথাযথই যুক্তিযুক্ত ছিল। তাঁর সব গুলি যুক্তিই ছিল কুরআন হাদীসের ভিত্তিতে প্রণীত। তিনি এ ব্যাপারে একটি গ্রন্থও রচনা করেন, তার নাম 'ইযালাতুল খিফা আন-খিলাফাতিল খুলাফা'।


(৫) শ্রমজীবীদের উপর থেকে অত্যধিক চাপ রহিত করা এবং শ্রমিক শ্রেণীর শ্রমের যথাযথ মূল্যায়ন দান: শাহ্ সাহেব বলেন, শ্রমজীবীদের উপর থেকে চাপ রোধ করা ব্যতীত সমাজে ভারসাম্য সৃষ্টি হতে পারে না।(বাস্তব প্রমাণ, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন)। অতীতে রোম পারস্যে যে নৈতিক অধঃপতন নেমে এসেছিল, তারও মূল কারণ ছিল শ্রমিক নিপীড়ন। সুতরাং সমাজে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হলে কুরআনের সেই বৈপ্লবিক চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। শাহ্ সাহের সেই চেতনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।


(৬) উম্মতে মুহাম্মাদীর সর্বস্তরের জনগণের প্রতি সংশোধনের আহবান: শাহ্ সাহেব দরস-তাদরীসের পাশাপাশি সমকালীন সামাজিক বিশৃংখলা ও তার ব্যাধি সম্পর্কে পুর্ন অবগত ছিলেন। তিনি সমাজের সকল স্তরের রোগ সম্পর্কে অবগত হয়ে সকলকে সংশোধনের প্রতি আহবান জানান।


(৭) শিক্ষা ও তারবিয়াতের মাধ্যমে যোগ্য উত্তরসুরী তৈরী করা:


যারা পরবর্তীতে তাঁর আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন এরূপ কিছু মর্দে মুজাহিদ তৈরী করাও তার কর্মসুচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরই প্রতিফলন হল শাহ আব্দুল আজিজ, শাহ্ মুহাম্মাদ ইসহাক, মুহাম্মদ বেলায়েত আলী, সৈয়দ আহমদ বেরেলভী, শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দী, শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) প্রমুখ আলেমগণ।


(৮) সমকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্যোগের কবল থেকে মুসলিম জাতিকে উদ্ধার করা: পুর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সম্রাট আলমগীরের মুত্যুর পর ভারতে যে রাজনৈতিক বিশৃংখলা দেখা দিয়েছিল, তা মুসলমানদের জন্য খুবই বিপদজনক ছিল। শাহ সাহেব মুসলিম জাতিকে এ দুর্যোগ থেকে উদ্ধারের লক্ষ্যে জনসাধারণের মাঝে জিহাদী প্রেরণা সৃষ্টি করেন।


ইন্তিকাল: ৬১ বৎসর বয়সে ১১৭৬ হিজরী ২৯শে মুহাররম যুহরের সময় হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ (রহঃ) দিল্লীতে ইন্তিকাল করেন। মুত্যুকালে তিনি চার জন যোগ্য সন্তান রেখে যান। তারা হলেন শাহ আব্দুল আজিজ, শাহ বদিউদ্দীন, শাহ আব্দুল কাদির ও শাহ আব্দুল গণী।


রচনাবলী : বিশেষজ্ঞগণের মতে, তাঁর রচনাবলী দুইশতের অধিক। হাদীছ, তাফসীর, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, রাষ্ট্রনীতি, তাসাউফ নির্বিশেষে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই তার অবদান রয়েছে।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url