সাওম কি।। সাওম কাকে বলে।। সাওময়ে ফজিলত।।সাওম সম্পর্কিত হাদিস।বাংলা হাদিস।
সাওম সম্পর্কিত কিছু কথা
শাহরু রামাজান। ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস। এ মাসেই কুরআনুল কারীমকে নাজিল করা হয়েছে। এ মাসেই রয়েছে লাইলাতুল কদর-যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ মাসেই খুলে দেয়া হয় জান্নাতের দরজাসমূহ। বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজাসমূহ। শয়তান ও দুষ্ট জীনদেরকে শেকলাবদ্ধ করা হয় এই মাসে। অসংখ্য পাপীদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হয় রমজানে। এটি দু'আ কবুলের মাস। যিকির-আজকার, তাসবীহ-তাহলীল, তাওবা-ইস্তিগফার ও কুরআন তিলাওয়াতের মাস। সহমর্মিতার মাস। আত্মসংযমের মাস। এটি জিহাদের মাস। এ মাসেই সংগঠিত হয়েছিলো ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ ও মক্কা অভিযানের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ। এ মাসেই ফরজ করা হয়েছে সিয়াম। যা ইসলামের পঞ্চবেনার একটি। এই সিয়ামের পুরস্কার দিবেন মহান আল্লাহ সুব: নিজ হাতে। কিন্তু এই সিয়ামকে যথাযথ মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে রয়েছে নানান অজ্ঞতা, বিভ্রান্তি ও কুসংস্কার ও জাহালত। আবার কেউ রমজানকে বরণ করছে মজুতদারি ও কালোবাজারির মাধ্যমে জিনিষ-পত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়ে। কেউবা পয়সার বিনিময়ে খতমে কুরআন, খতমে তাহলীল, খতমে খাজেগান, দুরূদে নারিয়া, দুরূদে তাজ, দুরূদে হাজারীসহ ইবাদতের নামে তৈরী করা বিভিন্ন বিদ'আতের মাধ্যমে। বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে হাদিয়া নামক টাকার বিনিময়ে হুজুরকে দিয়ে বিভিন্ন খতম বখশানোর মাধ্যমে।
আবার কেউবা রমজানকে বরণ করছে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার পরিবর্তে বিভিন্ন মাজারে, খানকায়, দরগায়, পীরের আস্তানায় গিয়ে খাজাবাবা, গাঁজাবাবা, লেংটাবাবা ও মাজার ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করার মাধ্যমে। গরীব-দুঃখী, অসহায় এতীম-মিসকীনদেরকে দান-খয়রাত করার পরিবর্তে বিভিন্ন মাজারে-ওরশে ও কোটিপতি পীরদেরকে টাকা- পয়সা, গরু-ছাগল-মুরগী, আগরবাতি-মোমবাতি, শিরনী-জিলাপী দানের মাধ্যমে। আবার কেউবা ইফতার মাহফিলের নামে রাজনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্যমে।রমজানের সিয়াম সাধনার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও সঠিক শিক্ষার অবর্তমানে সৃষ্ট এই নারকীয় পরিস্থিতি হতে মুক্তি পেতে হলে আমাদেরকে ফিরে আসতে হবে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে। জানতে হবে সিয়ামের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে। চলতে হবে রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কিরাম রা. এর অনুসৃত পথে।
এই কিতাবের মাধ্যমে আমরা উপরোক্ত বিষয়গুলোই কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। নিম্নে শাহরু রামাদান ও সিয়াম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় মাসায়েল, ফাজায়েল ও এ মাসে করণীয়- বর্জনীয় বিষয়গুলো প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
প্রশ্ন: সাওম )الصوم( কাকে বলে?
উত্তর: সাওম )صوم( শব্দের অর্থ 'বিরত থাকা' এর বহুবচন সিয়াম )صيام(। ইসলামের পরিভাষায় সাওম )صوم( বলা হয়:
الامساك عن المفطرات من طلوع الفجر الي غروب الشمس مع النية
অর্থ "সুবহে সাদেক থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়্যাতের সাথে সিয়াম ভঙ্গের কারণসমূহ থেকে বিরত থাকা।"
প্রশ্ন: সাওম )الصوم( এর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি?
উত্তর: সাওমের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ (সুব:) বলেন: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصَّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ
تَتَّقُونَ [البقرة/20]
অর্থ: "হে মুমিনগণ! তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো।' এ আয়াতে আল্লাহ (সুব:) সিয়াম ফরজ করার উদ্দেশ্যকে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছেন।
( সুরা বাকারা ১৮৩)
আমরা আর একটুকু
বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে গেলে যে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যগুলো দেখতে পাই তা হলো।
নিম্নরূপ:
প্রথমত:
আল্লাহ (সুব:) মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁর ইবাদাত করার জন্য। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হচ্ছে:
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُون} [الذاريات: 6]
অর্থ: "আমি মানুষ এবং জীনদের সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য।" আর সিয়ামের মাধ্যমে মানুষ তার রবের ইবাদত করে থাকে। কারণ একজন মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে তখন প্রথমে তার প্রতি আস্থাশীল হয়। তারপর তার আনুগত্য প্রকাশ করে। তারপর প্রয়োজনে তার জন্য বাড়ি-ঘর ত্যাগ করে। তারপর তার জন্য খানা-পিনা ইত্যাদি ত্যাগ করে। ঠিক তেমনিভাবে মানুষ ঈমানের মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল হয়। এরপর সালাতের মাধ্যমে প্রথমে আনুগত্য প্রকাশ করে। হজ্জের মাধ্যমে বাড়ি-ঘর ত্যাগ করে। যাকাতের মাধ্যমে অর্থ- সম্পদ ব্যায় করে। আর সাওমের মাধ্যমে খানা-পিনা ও স্ত্রীকে ত্যাগ করে। এভাবে সিয়ামের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ (সুব:) এর চুড়ান্ত ইবাদাহ (আনুগত্য) প্রকাশ করে থাকে।
দ্বিতীয়ত:
মানুষের মধ্যে দুইটি বিপরীতমুখি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একটি ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্য আর তা হচ্ছে আল্লাহর ইবাদাত করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে পশুর বৈশিষ্ট্য আর তা হচ্ছে খানা-পিনা করা, স্ত্রী ব্যবহার করা, সন্তান জন্ম দেয়া, ঘুম যাওয়া ইত্যাদি। কিন্তু এই দুইটি বৈশিষ্টের মধ্যে একমাত্র প্রথমটিই হচ্ছে মানবসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রয়োজন। সিয়ামের মাধ্যমে মানুষ পশুর বৈশিষ্ট্যকে ত্যাগ করে ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে যে, আমাদের খাওয়া-দাওয়া, স্ত্রী ব্যবহার করার চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আমরা সেগুলোকে ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদত করতে পারি।
তৃতীয়ত:
সিয়ামের মাধ্যমে মানুষ তার গোপন রোগ সমূহ যথা: কাম- ক্রোধ, লোভ-মোহ ইত্যাদির চিকিৎসা করে থাকে। কারণ যেভাবে সকল
জিনিষের মৌলিক উপাদান চারটি। ক. আগুন খ. পানি গ. মাটি ঘ. বাতাস। মানুষের মধ্যেও এই চারটি মৌলিক উপাদান বিদ্যমান। আর এগুলোর প্রতিটির মধ্যে একেকটি মারত্মক ক্ষতিকর রোগ রয়েছে।
আগুনের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হলো অহংকার। যদি আগুন জ্বালানো হয় তাহলে তা উপরের দিকে চড়তে থাকে। এ কারণেই ইবলিস অহংকার করেছিল। পানির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হলো লোভ। যে কারণে পানি সমতল জায়গায় ছাড়লে সে খুব সহজেই সাধ্যমত অনেক জায়গা দখল করে নেয়। মাটির স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হলো কৃপনতা। যে কারণে মাটির উপরে যা কিছু রাখা হয় আস্তে আস্তে সে তা নিজের ভেতরে লুকিয়ে ফেলে। আর বাতাসের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিজের অস্তিত্ব সর্বত্র বিরাজমান রাখা।
মানুষের মধ্যে যেহেতু উপরোক্ত চারটি উপাদানই রয়েছে তাই তার মধ্যে এই স্বভাবগুলোও বিদ্যমান। যেহেতু তার মধ্যে আগুন রয়েছে তাই তার মধ্যে অহংকার সৃষ্টি হয়। এই অহংকার রোগের চিকিৎসার জন্য আল্লাহ (সুব:) সালাতের বিধান দিয়েছেন। সালাতের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সামনে হাত বেঁধে অপরাধির ন্যায় দাড়িয়ে, তারপরে রুকুর মাধ্যমে মাথা ঝুকিয়ে তারপরে সেজদার মাধ্যমে তার সর্বশ্রেষ্ঠ অঙ্গ চেহারাকে মাটির সঙ্গে মিলিয়ে নিজেকে আল্লাহর গোলাম হিসাবে পেশ করে। সে যেন জানিয়ে দিল যে, আমি মাটি থেকেই তৈরি হয়েছি আবার মাটির সাথেই মিশে যাব আমার অহংকার করার কিছু নেই। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন:
مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى [طه: ]
অর্থ: "মাটি থেকেই আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, মাটিতেই আমি তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেব এবং মাটি থেকেই তোমাদেরকে পুনরায় বের করে আনব।""
م تا دو اپني هستي کو اگر کچھ مرتبه چاهو که دانه خاک میں ملکر گل گلزار هوتاهے
* সুরা তাহা ৫৫।
*
অর্থ: "তুমি যদি কিছু মর্যাদা অর্জণ করতে চাও তবে নিজের আমিত্বকে মিটিয়ে দাও। যেমনিভাবে একটি শস্য দানা নিজেকে মাটির সঙ্গে মিটিয়ে দিয়েএকটি সুন্দর বাগান উপহার দেয়।"
আবার যেহেতু মানুষের মধ্যে আরেকটি মৌলিক উপাদান রয়েছে মাটি। সেকারণেই মানুষ কৃপণ হয়। হাদীসে বলা হয়েছে:
عَنْ مُطَرِّفَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ أَتَيْتُ النَّبيَّ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ يَقْرَأُ أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ) قَالَ يَقُولُ ابْنُ آدَمَ مَالِى مَالِى قَالَ وَهَلْ لَكَ يَا ابْنَ آدَمَ مِنْ مَالِكَ إِلَّا مَا أَكَلْتَ فَأَفْنَيْتَ أَوْ لَسْتَ فَأَبْلَيْتَ أَوْ تَصَدَّقْتَ فَأَمْضَيْتَ ( صحيح مسلم)
অর্থ: "মুতাররিফ (রা:) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, আমি আল্লাহর রাসূল (সা:) এর নিকটে এলাম তখন তিনি الهاكم التكاثر পাঠ করছিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন: বনি আদম বলে থাকে 'আমার মাল, আমার মাল'। রাসূল (সা:) বলেন হে বনী আদম তুমি কি চিন্তা করে দেখেছ যে, তোমার কি মাল? তোমার মাল তো শুধু তাই যা তুমি পেট ভরে খেয়েছ এবং নষ্ট করেছ অথবা পরিধান করেছ এবং পুরাতন করেছ অথবা সাদাকাহ করেছ (আল্লাহর কাছে সঞ্চয় করেছ)। সুতরাং যেহেতু মানুষের মধ্যে এই কৃপণতার রোগ রয়েছে তাই এ রোগের চিকিৎসার জন্য আল্লাহ তায়ালা যাকাতের বিধান দিয়েছেন।
মানুষের মধ্যে আরেকটি মৌলিক উপাদান রয়েছে বাতাস। আর এই বাতাসের কারণেই মানুষ চায় যে সবাই তাকে জানুক। তার নাম প্রচার হোক। অর্থাৎ 'রিয়া' বা লৌকিকতা। অথচ এ 'রিয়া' বা লৌকিকতা হচ্ছে গোপন শিরক। তাই এ রোগের চিকিৎসার জন্য ফরজ করা হয়েছে হজ্জ।
হজ্জের জন্য মানুষকে এহরামের কাপড় পড়তে হয় এর মাধ্যমে পোষাকের গৌরব, ভাষার গৌরব ত্যাগ করে আরাফাহ, মুযদালাফাহ ও মিনার ময়দানে সাদা-কালো, আমীর-গরীব সকলকে একই ময়দানে অবস্থান করতে হয় কারো কোন বিশেষ মর্যাদা থাকে না। আর যখন কোন আলাদা বিশেষত্ব না থাকে তখন আর নাম-দাম প্রকাশের কোন সুযোগও থাকে না। এভাবে হজ্জের মাধ্যমে 'রিয়া' রোগের চিকিৎসা হয়ে যায়।
সর্বশেষ মৌলিক উপাদান হচ্ছে পানি। আর পানি স্বভাবগত বৈশিষ্ট হচ্ছে লোভ। সে কারণেই পানি যদি কোন সমতল জায়গায় ঢেলে দেওয়া হয় তাহলে সে আস্তে আস্তে আরো অনেক জায়গা দখল করে নেয়। মানুষের মধ্যে যেহেতু পানি আছে তাই এই পানির কারণেই মানুষের মধ্যে লোভ বিদ্যমান। যার ফলে সে সবসময় চিন্তা করে কিভাবে অন্যের সম্পদ, জায়গা-জমি দখল করা যায়, কিভাবে ভাল খাবার-দাবার, দামী পোষাক- পরিচ্ছেদের ব্যবস্থা করা যায়, কিভাবে অন্যের সুন্দরী স্ত্রী অথবা সুন্দরী মেয়েকে ভোগ করা যায়। এই রোগের চিকিৎসার জন্য আল্লাহ তায়ালা সাওমকে ফরজ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে:
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ
تَتَّقُونَ [البقرة/369]
অর্থ: "হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।"৪
একজন মানুষ যখন আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক সিয়াম পালন করে তখন তার সামনে যত লোভনীয় খানা-পিনা, সুন্দরী নারী পেশ করা হোক না কেন সে এগুলো আল্লাহকে ভয় করে বর্জন করবে। এটাকেই হাদীসে বলা হয়েছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رضى الله عنه قَالَ قَالَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم الصوم لى وَأَنَا أَجْزى به يَدَعُ شَهْوَتَهُ وَطَعَامَهُ مِنْ أَجْلى
অর্থ: "আবূ হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন নবী (সা:) বলেছেনঃ মহান আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ "কিন্তু রোযা আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিফল দান করবো। কেননা সে আমার জন্যই তার কামনা-বাসনা, খানা-পিনা ত্যাগ করে।""
এই হাদীসে বলা হয়েছে, 'সাওম আমারই জন্য': অথচ সকল ইবাদতই আল্লাহর জন্য। তবে অন্যান্য ইবাদত যেমন, সালাত, হজ্জ, যাকাত
* সুরা বাকারা ১৮৩।
* সহীহ বুখারী/৬৯৮৪; সহীহ মুসলিম/২৫৭৩ সুনানে নাসাঈ /২২১১: সুনানে তিরমিজি/৭৬১:
সনানে ইবনে মাজাহ ১৬৩৮।
ইত্যাদি লোক দেখানোর জন্য কেউ কেউ করতে পারে। কিন্তু রোযার মধ্যে লোক দেখানোর প্রবৃত্তি থাকে না। কারণ গোপনে পানাহার করলে আল্লাহ ছাড়া কেউই জানতে পারে না। আর একমাত্র আল্লাহর ভয় ছাড়া কিছু তাকে বাধা দেয় না। তাই আল্লাহ নিজেই এর প্রতিদান দিবেন। আর দাতা যখন নিজ হাতে দান করেন বেশীই দান করেন।
এ হাদীসে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সিয়ামের মাধ্যমে মানুষ তার রবের সন্তুষ্টির জন্য লোভ নিয়ন্ত্রণ করে পশুত্বের স্বভাবকে বিসর্জন দিয়ে 'আবদিয়্যাত' বা 'আল্লাহর দাসত্বের' সিফাতকে অর্জন করে। সুতরাং যদি সাওমের মাধ্যমে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন না হয় তাহলে শুধু শুধু খানা- পিনা ত্যাগ করে কোন লাভ নেই। রাসূলুল্লাহ (সা:) এ সম্পর্কে ইরশাদ করেন:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الرُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ (صحيح البخاري )
অর্থ: "আবূ হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করা সত্ত্বেও মিথ্যা কথা ও হারাম কাজ ত্যাগ করতে পারল না। তার খাবার-দাবার পরিত্যাগ করার ব্যাপারে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।"৬
অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা:) এরশাদ করেন:
عن ابي هريرة عن النبي صلى الله عليه وسلم قال كم من صائم ليس له من صيامه الا الظمأ وكم من قائم ليس له من قيامه الا السهر (سنن الدارمي)
অর্থ: "আবূ হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, অনেক সায়েম এমন আছে যার ভাগ্যে ক্ষুধা আর পিপাসা ছাড়া অন্য কিছুই নাই। অনেক রাত্রি জাগরণ করে ইবাদতকারী আছেন যাদের ভাগ্যে রাত্রি জাগরণ ব্যতিত আর কিছুই নাই।"৭
এ হাদীসগুলোতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শুধু ক্ষুধার্ত এবং পিপাসায় কাতর থাকার নামই সাওম নয়। বরং এর মাধ্যমে সকল প্রকার
* সহীহ বুখারী ১৯০৩।
* সুনানে দারমী ২/৩০১, হাদীসটি সহীহ।
* পশুত্বকে বর্জন করে এক 'ইলাহের' বিধান মেনে নিয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করাই সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য। সিয়াম অবস্থায় যখন আমরা উন্নতমানের খাবার ও সুন্দরী যুবতী নারীদের প্রতি আকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ (সুব:) এর নির্দেশ মেনে তা থেকে বিরত থাকি সেই একই আল্লাহর নির্দেশ মেনে মিথ্যা কথা, ধোঁকা দেওয়া, চোগলখোরি করা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, জেনা, ব্যাভিচার, রাহজানি, মদ, সুদ, জুয়া, উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা, খুন, ধর্ষণ, মূর্তিপূজা, আগুনপুজা, পীরপূজা, গাছপূজা, মাছপূজা, পাথরপূজা, মাজারপূজা, মন্ত্রিপূজা, এম-পি পূজা, নেতা-নেত্রী পূজাসহ সব কিছুকে বর্জন করতে হবে। এখানে একটি লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এই দীর্ঘ আলোচনায় প্রমাণিত হলো যে সালাত, যাকাত, সাওম, হজ্জ, এই চারটি হচ্ছে মৌলিক চারটি রোগের ঔষধ। আর এ কথা সকলেরই জানা যে, ঔষধ খেতে হলে অব্যশই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খেতে হবে। উল্টা-পাল্টা খেলে লাভের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার আশংকাই বেশী। ঠিক তেমনিভাবে এই চারটি ঔষধকেও নিজের মন মতো আদায় করলে চলবে না। বরং আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক, রাসূলুল্লাহ (সা:) এর তরীকা অনুযায়ী করতে হবে। এজন্যই একটি সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে:
عَنِ ابْنِ عُمَرَ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسَةِ عَلَى أَنْ يُوَحْدَ اللَّهُ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَصِيَامٍ رَمَضَانَ وَالْحَجِّ (بخاري ومسلم)
অর্থ: আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন: ইসলাম পাঁচটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। আল্লাহর এককত্ব ঘোষণা করা, সালাত কায়েম করা, যাকাত আদায় করা, রমজানে সিয়াম পালন করা এবং হজ্জ করা।
এই হাদীসে ইসলামকে একটি তাবুর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাবুর চার কোণায় চারটি খুটি থাকে এবং মাঝখানে একটি বড় পিলার থাকে। এই বড় পিলারটি যদি না থাকে তাহলে ঐ চার কোনার চারটি পিলারের কোনই মূল্য থাকে না। ঠিক তেমনিভাবে সালাত, যাকাত, সাওম, হজ্জ এগুলোরও কোনই মূল্য থাকবে না যদি শিরকমুক্ত তাওহীদ ও
* সহীহ মুসলিম ১৯ নং হাদীস; সহহি বুখারী ৮ নং হাদীস; সুনানে তিরমিজি ২৬০৯ নং হাদীস।
বেদআ'তমুক্ত সুন্নাহর উপরে প্রতিষ্ঠিত না হয়। একারনেই এ হাদীসে বলা হয়েছে ইসলামের বেনা পাঁচটি। আর তার মূল বেনা হলো ঈমান। আর এই কারণেই সাওমের সঙ্গেও এই শর্তটি গুরুত্বসহকারে জুড়ে দেয়া হয়েছে। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَلبه (صحيح البخاري)
অর্থ: আবূ হুরাইরা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা:)
ইরশাদ করেনঃ যে ব্যক্তি ঈমানসহ সওয়াবের আশায় রমযানের সিয়াম পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয় এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে ও সওয়াবের আশায় লাইলাতুল কদরে ইবাদত করে তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। এই হাদীসে স্পষ্টভাবে ঈমানের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। তাই তাওহীদের আক্বিদাহর ভিত্তিতে যদি সিয়াম পালন করা হয় তবেই সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য অর্জিত হবে।
চতুর্থত:
সিয়ামের মাধ্যমে গরীব-দুঃখী ও অসহায় মানুষের সত্যিকার অবস্থা উপলব্ধি করা যায়। কেননা সায়েম ব্যক্তি ভোর রাতে সাহরী খেয়ে আবার ইফতারীর পরে হরেক রকম খাবারের আয়োজন থাকা সত্ত্বেও বিকেল বেলা ক্ষুধার তাড়নায় ক্লান্ত হয়ে পরে। তাহলে যে গরীব পিছনের বেলা খেতে পায় নি, ভবিষ্যতের জন্য তার কোন আয়োজন নেই, তার মনের অবস্থা কি? এটা উপলব্ধি করে একদিকে আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। অপরদিকে গরীব-দুঃখী মেহনতি মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসা সিয়ামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। এজন্যই হাদীসে বলা হয়েছে:
عن سلمان انه قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم وهو شهر المواساة (صحيح ابن خزيمة لمحمد النيسابوري)
অর্থ: "সালমান (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুলাহ (সা:) বলেছেন: রমজান মাস হচ্ছে সহমর্মিতার মাস। "১০
শেষ কথা: এই লেখা টুকু কুতাবুস সাওম থেকে নেওয়া। লেখক :শায়খুল হাদিস জসিমউদদীন রহমানী।
এই কিতাবের বাকি আংশ পড়ুন:-