তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল।
তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল।
বিজ্ঞ আলেমদের মতে, তাহাজ্জুদ নামাজ একটি নফল নামাজ। এর হলো এটি সুন্নতে গায়রে মুআক্কাদা বা নফল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ নামাজ চার, ছয়, আট, দশ রাকাত, বারো রাকাত প্রমাণিত। এর থেকে বেশি বা কম পড়াতেও কোন সমস্যা । যেহেতু নফল, তাই যত ইচ্ছা পড়া যায়। দুই রাকাত দুই রাকাত করে যত রাকাত সম্ভব পড়তে পারেন। তবে রাসুল সা. দীর্ঘ সুরা তিলাওয়াত করতেন তাহাজ্জুদ নামাজে।
তাহাজ্জুদ নামাজ কি?
তাহাজ্জুদ (تهجد) অর্থ ঘুম থেকে জাগা। তাহাজ্জুদ নামাজ বা রাতের নামাজ হচ্ছে একটি নফল ইবাদত, ফরয নামাজের পর অন্যান্য সুন্নাত ও নফল সব নামাযের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ফযীলত সবচেয়ে বেশী।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার আগে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওপর তাহাজ্জুদ নামাজ বাধ্যতামূলক ছিল। তাই তিনি জীবনে কখনো তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া থেকে বিরত থাকেন নি। তবে উম্মতে মুহাম্মদির জন্য এটা সুন্নাতে গায়রে মুয়াক্কাদা অর্থাৎ এ নামাজ আদায় করলে অশেষ পুণ্য লাভ করা যায়, কিন্তু আদায় করতে না পারলে কোনো গুনাহ হবে না।
তাহাজ্জুদ নামাজের সময়
তাহাজ্জুদ নামাজের সময় হল সালাতুল ইশার পর থেকে সুবহে সাদিক এর পূর্ব পর্যন্ত। তবে রাতের শেষ তৃতীয়াংশে পড়া উত্তম।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিতঃ-
রাসূল (সাঃ) বলেনঃ- মহান প্রভু, প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং তিনি বলতে থাকেনঃ কোন দোয়া কারী আছো কি? আমি তার দোয়া কবুল করব! কোন প্রার্থনাকারি আছো কি? আমি তার প্রার্থিতবস্তু দান করব! কোন ক্ষমা প্রার্থী আছো কি? আমি আজ তাকে ক্ষমা করে দেবো! এভাবে প্রভু তার বান্দাদেরকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত ডাকতে থাকেন।
(সহীহ বুখারী: ১/১৫৩)
মাসআলাঃ-তবে ঘুম থেকে ওঠার সম্ভাবনা না থাকলে বেতের নামাজ আদায়ের পরেও তাহাজ্জুদের নিয়তে কিছু নামাজ পড়ে নেওয়া যায়।
তাহাজ্জুদ নামাজ কত রাকাত
তাহাজ্জুদ নামাজ ৪ রাকাত থেকে ১২ রাকাত পর্যন্ত পড়া যায়। রাসূল সাঃ ৮ রাকাত পড়তেন তাই এটাই উত্তম। তবে যার যতটুকু সাধ্য সে অনুযায়ী পড়বে! কারো যদি শেষ রাতে উঠার প্রবল আত্মবিশ্বাস থাকে সে বেতেরও শেষ রাতে পড়বে। অন্যথায় অবশ্যই বেতের এশার পরপরই আদায় করে নিবেন।
রাসূল সাঃ রমজান এবং রমজানের বাহিরে ১২ রাকাতের বেশি পড়তেন না! প্রথমে ৪ চার রাকাত পড়তেন! এরপর ৪ রাকাত পড়তেন! যার দীর্ঘতা ও সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না! অতঃপর তিনি তিন রাকাত বেতের পড়তেন।
(সহীহ মুসলিম: ১/২৫৪)
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, "আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, "আফজালুস সালাতি বাদাল মাফরুদাতি সালাতুল লাইলি" অর্থাৎ "ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ" - (মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ)
তাহাজ্জুদের নামায অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও ফযিলতপূর্ণ ইবাদত। যারা বিনা হিসাবে জান্নাতে যেতে পারবেন, তাদের মধ্যে এক শ্রেণীর মানুষ হলেন তারা, যারা অতিব মহব্বতে সঙ্গে সালাতুল তাহাজ্জুদ আদায় করেন। এটি একটি নফল ইবাদত তবে নফল ইবাদতের মধ্যে এটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি ইবাদত। তাহাজ্জুদের নফল নামাজকে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রেষ্ঠ নফল ইবাদত হিসাবে অ্যাখ্যায়িত করেছেন। তিনি নিয়মিত তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করতেন এবং সাহাবীদের তাহাজ্জুদের সালাত আদায়ে উৎসাহিত করতেন। কুরআনের বিভিন্ন সুরা'য় এ নামাজের প্রতি তাগিদ দেয়া হয়েছে।
তাহাজ্জুদ সালাতের নিয়ম, নিয়ত ও দোয়া
নিয়ম:
- তাকবিরে তাহরিমা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে নিয়ত বাঁধা।
- অতঃপর ছানা পড়া।
- সুরা ফাতেহা পড়া।
- সুরা মিলানো তথা কেরাত পড়া।
- অতঃপর অন্যান্য নামাজের ন্যায় রুকু, সেজদা আদায় করা।
- এভাবেই দ্বিতীয় রাকাআত আদায় করে
- তাশাহহুদ, দরূদ ও দোয়া মাছুরা পড়ে সালাম ফেরানোর মাধ্যমে নামাজ সম্পন্ন করা।
- এভাবে দুই দুই রাকাআত করে ৮ রাকাআত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা উত্তম।
- যদি এশার নামায পরে বিতরের নামায পড়ে থাকেন, তবে তাহাজ্জুত নামায পড়ার পড়ে বিতরের নামায পড়ার দরকার নেই। তখন ২ রাকাত থেকে শুরু করে ৮রাকাত তাহাজ্জুত নামায পরলেই হবে।
তাহাজ্জুদ নামাজের আরবি নিয়ত:-
কোন নামাজের নিয়তই আরবিতে করা জরুরী নয়! তবে আপনি যদি বিশুদ্ধ আরবি পারেন চাইলে আরবিতেও করতে পারেন। নিম্নে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত আরবিতে দেওয়া হলঃ-
نَوَيْتُ أَنْ أُصَلِّيَ لِلَّهِ تَعَالَى رَكْعَتَيْ صَلَاةِ التَّهَجُّدِ سُنَّةَ رَسُولِ اللَّهِ تَعَالَى مُتَوَجِّهًا إِلَى جِهَةِ كَعْبَةِ الشَّرِيفَةِ، اللَّهُ أَكْبَرُ
উচ্চারণঃ- নাওয়াইতোয়ান উছললিয়া লিল্লাহি তায়া’লা রক’আতাই সলাতিত তাহাজ্জুদি, সুন্নাতু রসুলিল্লাহি তায়া’লা, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতি কা’বাতিশ সারিফাতি “আল্লাহু আকবার”
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতে তাহাজ্জুদের উদ্দেশে যখন দাঁড়াতেন, তখন এ দোয়া পড়তেন:-
বাংলা উচ্চারণ:- আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু আংতা কায়্যিমুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না ওয়া লাকালহামদু। লাকা মুলকুস সামাওয়অতি ওয়াল আরদি ওয়া মান ফিহিন্না। ওয়া লাকাল হামদু আংতা নুরুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদ। ওয়া লাকাল হামদু আংতাল হাক্কু। ওয়া ওয়া’দুকাল হাক্কু। ওয়া লিক্বাউকা হাক্কু। ওয়াল ঝান্নাতু হাক্কু। ওয়ান নারু হাক্কু। ওয়ান নাবিয়্যুনা হাক্কু। ওয়া মুহাম্মাদুন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা হাক্কু। ওয়াস সাআতু হাক্কু। আল্লাহুম্মা লাকা আসলামতু। ওয়াবিকা আমাংতু ওয়া আলাইকা তাওয়াক্কালতু। ওয়া ইলাইকা আনাবতু। ওয়া বিকা খাসামতু। ওয়া ইলাইকা হাকামতু। ফাগফিরলি মা কাদ্দামতু ওয়া মা আখ্খারতু। ওয়া মা আসরারতু ওয়া মা আ’লাংতু। আংতাল মুকাদ্দিমু ওয়া আংতাল মুআখ্খিরু। লা ইলাহা ইল্লা আংতা। লা ইলাহা গাইরুকা।’ (বুখারি)
তাহাজ্জুদ সালাতের বাংলা নিয়ত:-
ওলামায়ে কেরাম আরবি থেকে বাংলাতে নিয়ত করাটাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কারণ আমরা বিশুদ্ধ আরবি উচ্চারণ করতে জানিনা। নিম্নে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত বাংলায় দেওয়া হলঃ-
আমি কেবলামুখী হয়ে আল্লাহর জন্য দু’রাকাত তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করছি। “আল্লাহু আকবার”
তাহাজ্জুদ নামাজে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যে দোয়া পড়তেন:
প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ আদায়ের জন্য ওঠে কুরআনের এ আয়াতসহ সুরা আল-ইমরানের শেষ পর্যন্ত পড়তেন। - (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত)
رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذا بَاطِلاً سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ – رَبَّنَا إِنَّكَ مَن تُدْخِلِ النَّارَ فَقَدْ أَخْزَيْتَهُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ – رَّبَّنَا إِنَّنَا سَمِعْنَا مُنَادِيًا يُنَادِي لِلإِيمَانِ أَنْ آمِنُواْ بِرَبِّكُمْ فَآمَنَّا رَبَّنَا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرْ عَنَّا سَيِّئَاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ الأبْرَارِ
উচ্চারণ: রাব্বানা মা খালাক্বতা হাজা বাত্বিলান, সুবহানাকা ফাক্বিনা ‘আজাবান্নার। রাব্বানা ইন্নাকা মাং তুদখিলিন্নারা ফাক্বাদ্ আখঝাইতাহু, ওয়া মা লিজজ্বালিমিনা মিন্ আংছার। রাব্বানা ইন্নানা সামি’না মুনাদিআই ইউনাদি লিল ইমানি আন আমিনু বিরাব্বিকুম ফাআমান্না; রাব্বানা ফাগফিরলানা জুনুবানা ওয়া কাফ্ফির আন্না সাইয়্যেআতিনা ওয়া তাওয়াফ্ফানা মাআ’ল আবরার।’
৪০ দিন তাহাজ্জুদ সালাতের ফজিলত
তাহাজ্জুদ নামাজ টানা ৪০ দিন আদায় করেন বিশাল সওয়াব রয়েছে। আল্লাহর কাছে যা চাওয়া হবে অবশ্যই আল্লাহ তাআলা দিবেন। পৃথিবীর যে কোনো সমস্যা আল্লাহর কাছে চাইলে আল্লাহ ফিরিয়ে দিবেন না।
বিঃদ্রঃ তাহাজ্জুদ নামাজের নির্দিষ্ট কোন কেরাত/সূরা নেই। যেকোনো সূরা দিয়ে নামাজ আদায় করতে পারবেন। তবে রাসুল সাঃ যেহেতু দীর্ঘ সময় নিয়ে এই নামাজগুলো আদায় করতেন সে হতো বড় কেরাত নেওয়া উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামাজ সুন্নত নাকি নফল?
তাহাজ্জুদ নামাজ নফল এবং অন্যান্য নাওয়াফেল নামাজের মধ্য থেকে তাহাজ্জুদ অধিক মর্যাদা ও ফজিলত পূর্ণ।
তাহাজ্জুদ নামাজ কয় রাকাত?
তাহাজ্জুদ যেহেতু নফল নামাজ তাই এই নামাজের নির্দিষ্ট কোন রাকাত নেই। তবে রাসুল ﴾ﷺ﴿ ৮ রাকাত পড়তেন এবং এটাই উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামাজ কোন সূরা দিয়ে পড়তে হয়?
এ-নামাজের নির্দিষ্ট কোন সূরা নেই! যে কোন সূরা দিয়ে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা যায়! তবে তাহাজ্জুদ নামাজে লম্বা কেরাত নেওয়া উত্তম।
তাহাজ্জুদ নামাজ কি অন্ধকারে পড়তে হয়?
অনেকেই মনে করেন তাহাজ্জুদ নামাজ অন্ধকারে পড়তে হয়! আসলে এ-কথাটি ভিত্তিহীন।
তাহাজ্জুদ নামাজের আরবি নিয়ত
نَوَيْتُ أَنْ أُصَلِّيَ لِلَّهِ تَعَالَى رَكْعَتَيْ صَلَاةِ التَّهَجُّدِ سُنَّةَ رَسُولِ اللَّهِ تَعَالَى مُتَوَجِّهًا إِلَى جِهَةِ كَعْبَةِ الشَّرِيفَةِ، اللَّهُ أَكْبَرُ
তাহাজ্জুদ নামাজ কি দুই রাকাত পড়া যায়?
অবশ্যই! যেহেতু এটি ঐচ্ছিক নামাজ ইচ্ছামত যে করাকাত সম্ভব হয় সে করাকাত আদায় করবেন। যেহেতু নফল ইবাদত যত সে হত যত বেশি পড়বেন তত বেশি সওয়াব।